অক্টোবর বিপ্লবের ১০০ বৎসর ও কাজী নজরুল ইসলাম” শীর্ষক সেমিনার

18 November 2017

অক্টোবর বিপ্লবের ১০০ বৎসর ও কাজী নজরুল ইসলাম” শীর্ষক সেমিনার

কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনে অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব অনস্বীকার্য। তাঁর নানা লেখায় অক্টোবর বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব দৃশ্যমান। অক্টোবর বিপ্লব যেখানে সারা বিশ্বেই এক যুগান্তকারী ইতিবাচক পরিবর্তনের সুচনা করেছে সেখানে নজরুলের অক্টোবর বিপ্লব দ্বারা আন্দোলিত ও প্রভাবিত হওয়াটা স্বাভাবিক। নজরুলের ব্যক্তিজীবন, তাঁর চিন্তাধারা এবং তাঁর বিভিন্ন লেখাতে অক্টোবর বিপ্লবের স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

নজরুলের লেখায় অক্টোবর বিপ্লবের আদর্শিক প্রভাব নিয়ে যুব ইউনিয়নের সদস্য জনাব হাবীব ইমন লিখেছেন, “তার যে কবিতাটি প্রথম পত্রিকায় ছাপানো হয় সেটির নাম ‘মুক্তি’। কবিতাটি ছাপানো হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য়। রাশিয়া বিপ্লবে সর্বহারার রাষ্ট্র গঠনের সংবাদে নজরুলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হলো এই ভাষায়– ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’ তাঁর ‘মুক্তি’ কবিতায় ফকিরের মুক্তির মতোই সর্বহারা বিপ্লবের উজ্জ্বল শিখায় সব বাঁধন বা আগল খসে পড়লো। মুজফ্ফরের উক্তি: ‘তার সিন্ধুপারের ‘আগল ভাঙা’ মানে রুশ বিপ্লব। তার প্রলয় মানে ‘বিপ্লব’। আর জগৎ-জোড়া বিপ্লবের ভেতর দিয়েই আসছে নজরুলের নূতন অর্থাৎ আমাদের দেশের বিপ্লব। এই বিপ্লব আবার সামাজিক বিপ্লবও’ (কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা)। মুক্ত চেতনায় দেদীপ্য কবির হাত ধরলো কলম, কণ্ঠ ধরলো গান, হৃদয় উজাড় করে বেরোতে থাকলো।

নজরুলের আন্তর্জাতিক চেতনা যে বিশ্বের সর্বহারাদের বিপ্লবের প্রতি কতটা আগ্রহী ছিল, তা বোঝা যায় ১৩৩৪ সালে ১ বৈশাখের সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ পত্রিকার জন্য রচিত তিনটি গানের বাণী থেকে, যার প্রথমটি রেডফ্ল্যাগ বা রক্তপতাকার গান–‘ওড়াও ওড়াও লাল নিশান/ দুলাও মোদের রক্তপতাকা/ ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান/ ওড়াও ওড়াও লাল নিশান/...চিরবসন্ত যৌবন করে ধরা শাসন/ নহে পুরাতন দাসত্বের ঐ বদ্ধমন’। দ্বিতীয় গানটি হলো, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রথম বঙ্গানুবাদ অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত, ‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠ রে যত/ জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত/ যত অত্যাচারে আজি বজ্রহানি/ হাঁকে নিপীড়িত জন-মন-মথিত-বাণী’...আর তৃতীয় গানটি হলো, ‘জাগর-তূর্য’ (শেলীর ভাব অবলম্বনে)–‘ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর-অধিকারী/ অলিখিত যত গল্প-কাহিনী তোরা যে নায়ক তারি’/...নিদ্রোত্থিত কেশরীর মত/ ওঠ্ ঘুম ছাড়া নবজাগ্রত/ আয় রে অজেয় আয় অগণিত দলে দলে মরুচারী/ ঘুমঘোরে ওরে যত শৃঙ্খল/ দেহ-মন বেঁধে করেছে বিকল/ ঝেড়ে ফেল সব, সমীরে যেমন ঝরায় শিশির-বারি/ উহারা ক’জন? তোরা অগণন সকল শক্তি-ধারী।’ শ্রমিকশ্রেণি হচ্ছে সর্বহারা বিপ্লবের ভ্যানগার্ড বা অগ্রপথিক। নজরুল ওয়াল্ট হুইটম্যানের ও পাইওনিয়ার অবলম্বনে ‘অগ্রপথিক’ কবিতায় লিখেছেন- ‘রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন্ ভাইরা মোর,/ বসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!/ রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান,/ হান রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ!/ কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?/ অগ্রপথিক রে সেনাদল,/ জোর কদম্ / চল রে চল।’

নজরুলের একাধিক কবিতায় অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব পড়েছে। তার ‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী, ফরিয়াদ’, ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলোয়োল্লাস’ প্রভৃতি কবিতা ও একাধিক গান এ ধারণার যর্থাথতা নিশ্চয় আছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বিদ্রোহ তো বিদ্রোহের একটি ভঙ্গিমায় প্রকাশমাত্র নয়, সে যে বিপ্লবেরই পূর্বাভাস। তার মধ্যে আমিত্বের অহংকারের যে ব্যঞ্জনা, তা তো জরাজীর্ণ প্রথাবদ্ধ পুরাতন যা কিছু তাকে গুড়িয়ে দেবারই নিশানা। কবিতাটি বাংলার বিপ্লববাদীদের ঘোষণাপত্রের ভূমিকা পালন করেছে, সবরকম ভীরুতা, দীনতা থেকে মুক্ত হয়ে সাহসের ও স্পর্ধার সাথে এগিয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে। এই কবিতাটি শোনানোর পরে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।

‘সাম্যবাদী’ কবিতার প্রথম চার লাইন : ‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান। যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান/গাহি সাম্যের গান’– এটি ভারতের অনুষঙ্গে লেখা হলেও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এর পেছনে অক্টোবর বিপ্লবের সাম্যের দ্যোতনা রয়েছে। কিংবা ওই সুদীর্ঘ কবিতারই আর একটি স্তবকের প্রথম চার পংক্তি : ‘গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নহে কিছু মহীয়ান/ নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ. অভেদ ধর্মজাতি, সবদেশে সবকালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি’–এর মধ্যে আন্তর্জাতিকতার সুরটি লুকিয়ে রয়েছে তারও মূল খুঁজতে গেলে রাশিয়া বিপ্লবের ভাবের ভেতরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কিংবা ‘ফরিয়াদ’ কবিতার শেষ চার লাইন : ‘মুক্ত কণ্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান–জয় নিপীড়িত প্রাণ। জয় নব অভিযান জয় নব উত্থান’–এ কোন অভিযান, কোন উত্থানের নান্দী গাওয়া হচ্ছে। সেই গণমানুষেররই জয়ধ্বনি কি উদগীরিত হয়নি অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্যের মধ্য দিয়ে? অথবা ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতার শেষ দুই পংক্তি: ‘প্রার্থনা করো–যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত- লেখায় তাদের সর্বনাশ।’

এ কোন সর্বনাশের ইঙ্গিত চরণ দুটির মধ্য দিয়ে স্ফূরিত হচ্ছে? প্রকৃত পক্ষে অক্টোবর বিপ্লব একটি সর্বব্যাপি ভাবের পটভূমি রূপে নজরুলের কবিতার পিছনে বিদ্যমান রয়েছে। ১৯২২ সালের এপ্রিল মাসে নজরুল কুমিল্লায় অবস্থানকালে ‘প্রলয়োল্লাস’ নামে একটি কবিতা লেখেন। এটি পরে কোরাস গান হিসেবে বহুলভাবে প্রচারিত হয়। তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/ কালবোশেখীর ঝড়। প্রলয়োল্লাস কবিতাটির একাংশে আছে– মাভৈঃ মাভৈ। জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে। / জরায় মরা মুমূর্ষদের প্রাণ লুকানো ওই বিনাশে। মুজজফর মনে করেন–‘জগৎ-জোড়া যে প্রলয়ের ইঙ্গিত করা হয়েছে তা রাশিয়া বিপ্লবের ভিন্ন আর কিছু নয়। কাজী নজরুল ইসলামের মাধ্যমেই প্রথম বাংলা সাহিত্যে অক্টোবর বিপ্লবের আবাহনী রচিত হয়।”

নজরুল ও অক্টোবর বিপ্লবের এই সুগভীর আন্তঃসম্পর্ক ও এর গুরুত্বের কারণে বাঁশরী অক্টোবর বিপ্লবের ঐতিহাসিক ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর “অক্টোবর বিপ্লবের ১০০ বৎসর ও কাজী নজরুল ইসলাম” শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত ও অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ, বিশিষ্ট আবৃত্তিকার সীমা ইসলাম, উপস্থাপক, আবৃত্তিকার রেজাউল হোসেন টিটো ও বাঁশরীর সভাপতি ড. ইঞ্জি. খালেকুজ্জামান।