জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে  আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

25 May 2025

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

২৫শে মে ২০২৫/১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন ত্রিশালের দরিরামপুরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ৩ দিনব্যাপী এক আলোচনাসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।


এ বছর এ আয়োজনের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য ছিল, “২৪ এর গণঅভ্যুত্থান, কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার” এবং মূলসুর ছিল, “গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”।

এ আয়োজনে আমন্ত্রিত বাঁশরী - একটি নজরুল চর্চা কেন্দ্র’র শিল্পীগণ অন্যান্য সমমনা সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন এবং স্মারক বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত বাঁশরীর প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ড. ইঞ্জিনিয়ার খালেকুজ্জামান বক্তৃতা প্রদান করেন।


ড. ইঞ্জিনিয়ার খালেকুজ্জামান “২৪ এর গণঅভ্যুত্থান, কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার।” এ প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, স্মারক বক্তৃতায় তাকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি তার জন্য অনেক বড় একটি বিষয়। তবে গবেষক পরিচয় তার জন্য একটু বেশী হয়ে যায়, বরং নিজেকে তিনি একজন নজরুল ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও তার রক্তের মধ্যে প্রতিনিয়ত নজরুল চেতনা প্রবাহিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।


উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহের কবি, নারী স্বাধীনতার কবি, সর্বোপরি সম্প্রীতির কবি। তিনি ছিলেন একজন ক্ষুরধার প্রবন্ধকার, যার ক্ষুরধার প্রবন্ধ মানুষকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করতো। তিনি ছিলেন একজন গল্পকার, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার গল্প পাঠকমহলে সুপরিচিত নয়। তিনি কবির রচিত ৩টি উপন্যাসের কথা বলেন, কিন্তু এগুলো সবখানে সহজলভ্য নয় বলে উল্লেখ করেন। নজরুল ছিলেন একজন নাট্যকার, কিন্তু তিনি অসুস্থ্য হওয়ার পর বিগত ৮০ বছরে কোথাও তার নাটক মঞ্চস্থ হয়নি। ড. খালেকুজ্জামান বলেন, তিনি তার সাংস্কৃতিক সংগঠন বাঁশরী- একটি নজরুল চর্চা কেন্দ্র’র মাধ্যমে গত দুই বছর যাবৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নজরুল রচিত নাটকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি নজরুলের সাংবাদিকসত্তার ওপরও আলোকপাত করেন। তাঁর মতে, কবি নজরুল সাংবাদিক হিসেবে কী ভূমিকা পালন করেছেন, তা আমাদের নিজেদের পরিশুদ্ধ করার জন্য জানা দরকার। সাংবাদিক হিসেবে তিনি কারো রক্তচক্ষুর কাছে মাথা নত করেছিলেন নাকি স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতেন সেটাও আমাদের জানা দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি। পাশাপাশি, কবি নজরুলের সাংবাদিক জীবন নিয়ে লেখার জন্য তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের আহ্বান জানান।

তার তথ্যবহুল আলোচনায় তিনি জানান, কবি নজরুল অনেকগুলো সিনেমার সাথেও নানাভাবে জড়িত ছিলেন এবং অনেকগুলো সিনেমার জন্য গান লিখেছিলেন। এসব নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিৎ বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, নজরুল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সুরস্রষ্টা। নজরুলের বিশালসংখ্যক গানের সংখ্যা নিয়ে মতভেদের বিষয়টিও তিনি সামনে নিয়ে আসেন। কবি নজরুল রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন, তবে তাঁর রাজনীতি ছিল সত্যিকার অর্থেই মানবকল্যাণে নিবেদিত বলে জানান তিনি।

তাঁর নির্ধারিত আলোচনার বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের সাথেও নজরুলের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চেতনা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করেছে বলে তিনি মনে করেন। এ আন্তঃসম্পর্কের কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি উদাহরণ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন ও অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেয়াল লিখন, স্লোগান ও প্ল্যাকার্ডে কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন গান ও কবিতার ছত্র বহুল ব্যবহারের কথা বলেন।

মানবাধিকারের কথা বলতে গিয়ে তিনি ১৯২৫ সালে নজরুলের রচিত ‘সাম্যবাদী’ কবিতার কথাও উল্লেখ করেন। এ কবিতাটি রচনার তাৎপর্য উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদ ১৯৪৮ সালে ঘোষিত হয়, অথচ তারও অনেক আগেই ১৯২৫ সালে কবি তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় মানবতা ও মানবাধিকারের জয়গান গেয়েছেন। সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছের আরেকটি কবিতা ‘মানুষ’ কবিতায়ও কবির মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ‘মানুষ’ কবিতার “গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান” এবং “জয় হোক, জয় হোক” প্রভৃতি কালজয়ী কবিতা ও গানের অংশবিশেষের তাৎপর্য তিনি আলোচনা করেন। “আমরা সকলে নজরুলের পথ ধরে শান্তিতে থাকবো এবং একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়বো” এই আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি তাঁর আলোচনাধর্মী বক্তব্য সমাপ্ত করেন।


এ আয়োজনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে বাঁশরীর শিল্পীগণ কাজী নজরুল ইসলাম রচিত শ্রোতানন্দিত ভিন্ন অঙ্গের গান একক ও সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনান। বাঁশরীর পরিবেশিত জনপ্রিয় এ গানগুলোর মধ্যে “জয় হোক, জয় হোক”, “তোরা সব জয়ধ্বনি কর”, “মোহাম্মদ মোস্তফা, সাল্লেয়ালা, তুমি বাদশারও বাদশা”, “কুচ বরণ কন্যা রে, তার মেঘ বরণ কেশ”, “আমার হাতে কালি, মুখে কালি” উল্লেখযোগ্য। বাঁশরীর শিল্পী সিদ্ধার্থ গোলদার একক কণ্ঠে পরিবেশন করেন “মোর প্রিয়া হবে, এসো রাণী, দেব খোঁপায় তারার ফুল”। স্বনামধন্য নজরুল সংগীতশিল্পী শহীদ কবির পলাশ নজরুলের তুমুল জনপ্রিয় দু’টি গান “চেয়ো না সুনয়না, আর চেয়ো না এ নয়ন পানে”, এবং “আলগা কর গো খোঁপার বাঁধন” পরিবেশন করেন।

বাঁশরীর এ নজরুল সংগীত পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন যথাক্রমে বাঁশরীর নজরুলসংগীতশিল্পী নওশীন অমি, তাপসী রায়, হৃদয় খান, মনসুর আলী, সিদ্ধার্থ গোলদার, গুলে ফেরদৌস লতা, সংগীতা পাল, উম্মে রুমা ট্রফি এবং শহীদ কবির পলাশ।